বুধবার, ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজ বুধবার | ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার গরম, দিশেহারা ক্রেতা

শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩ | ১০:৫৬ অপরাহ্ণ

রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার গরম, দিশেহারা ক্রেতা

পবিত্র রমজান মাস ঘরে আসার দিনকতক আগেই বাজারে পণ্য মূল্যের পারদ উর্ধ্বমুখি হয়ে উঠে। ব্যবসায়ীরা মজুদদারির কথা অস্বীকার করলেও বাজার নির্দেশনা কেহ মানছেনা। নারায়ণগঞ্জে বাজারগুলোতে রমজান নির্ভর পণ্যের দাম বাড়তি। বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে মানুষ বাড়তি দামে জিনিসপত্র কিনছে। ব্যবসায়ীদের মুখে সেই পুরনো বুলি ‘বেশি দামে কেনা বেশি দামে বিক্রি। আমাদের কিছু করার নেই’। সাধারণ মানুষের পক্ষে পণ্যের আমদানি মূল্য জানার কোন উপায় না থাকায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে সাধারণ মানুষের পকেট কাটে বৈধ পন্থায়। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তদেরও বেসামাল দশা। এ থেকে কবে মিলবে পরিত্রাণ- এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

রোজা সামনে রেখে সদাইপাতি কিনতে বাজারে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সোহাগ হক। দুই লিটার তেল, এক কেজি চিনি আর যৎসামান্য মসুর ডাল, ছোলা, বেসন ও খেজুর কিনতেই উধাও হয়ে গেছে হাজার টাকা। বাজারদর নিয়ে কথা শুরু হতেই ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি।

শহরের আমলাপাড়ার বাসিন্দা সোহাগ বলেন, এখনো মসলাপাতি, মুড়ি, মাংস, ডিম কেনা হয়নি। পেঁয়াজ, মরিচ, লেবুসহ আরও কত কি বাকি! কিন্তু পকেট হয়ে গেছে গড়ের মাঠ!
আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, ইফতারের সময় যে একটু শরবত মুখে দেব, তারও জো নেই! ১০০ গ্রাম ইসবগুলের ভুষি ৩৫০ টাকা, চিনির কেজি ১১৫ টাকা। এই যদি হয় বাজারের অবস্থা, রোজায় কি খেয়ে থাকব। জিনিসপত্রের দামে আমাদের দম বন্ধ দশা। এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে কবে।

বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পেরে উঠছেন না গৃহকর্মী খোদেজাও। গৃহস্থের বাসার কাজ করে সামান্য যে আয় তা দিয়ে বাসা ভাড়া দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই। এমন পরিস্থিতিতে রোজায় ডাল-ভাত, তরিতরকারি খেয়েও চলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খোদেজা বলেন, মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়েছি। নতুন করে ডিমও খাই না। ডাল-ভাত, শাকপাতা আর আলুর তরকারি খাইতেও তো তেল, নুন, মসলা লাগে। সেগুলোর দাম তো আকাশছেঁায়া। রোজার ৩০টা দিন পোলাপাইনগুলারে নিয়া কীভাবে পার করমু জানি না। খাওয়া কমাইয়াও কুলাইতে পারতাছি না। বাইচা থাকাই কঠিন হইয়া গেছে।
এদিকে দিগুবাবুর বাজার, কালি বাজার, মাসদাইর বাজার শহরতলী ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় রমজান মাসকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা বাজার। ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, মাছ-মাংস, দুধ, ডিমের বাজার আগে থেকেই আগুন। চাল, ডালের খরচও কুলিয়ে উঠতে পারছে না বেশির ভাগ ভোক্তা।

রোজার মাসে চাহিদা থাকলেও ছোলা, খেজুর, মুড়ির খরচও পড়ছে অনেকের কঁাধে। গরিবের অ্যাংকর ডালের দামটাও এ বছর রোজায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সামান্য লবণটাও গত রোজার চেয়ে ৮ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে।

অপরদিকে রোজায় দ্রব্যমূল্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিতের লক্ষ্যে অসাধু চক্রদের ঠেকাতে টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। রোজার মাসে ‘কালোবাজারি, মজুদদাররা’ যাতে বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে না পরে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

পণ্যের সংকট সৃষ্টির চেষ্টাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অপরদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, আইনশৃংখলাবাহিনীসহ সরকারি একাধিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে বরাবরের মতো ‘দাম বাড়বে না’ বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের দাবি, রোজা উপলক্ষে নিত্যপণ্যের চাহিদ অনেক হারে বাড়লেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কারণে আমদানি এবার কম এবং বিশ্ববাজারের কারণে দামও বাড়তি রয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা বেড়েছে, যা সন্তোষজনক। সুতরাং রোজায় পণ্যের সংকট হবে না। কিন্তু ভোক্তারা এর সুফল পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বাজারচিত্র ও সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে এক বছরে জিনিসপত্রের কী পরিমাণে বেড়েছে তা যাচাই করলে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে এবার প্রতি কেজি মোটা চালে ১ থেকে ২ টাকা, খোলা আটায় ২০ টাকা, চিনিতে ৪০ টাকা, ছোলায় ২০ টাকা, অ্যাংকর ডালে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে। প্রতিলিটার সয়াবিনের বোতল প্রতি এবার রোজায় ২০ টাকা বেশি খরচ করতে হবে। এ ছাড়া খেজুরের কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত খরচ বেড়েছে।

অপরদিকে মসলার বাজারে এবার পেঁয়াজ বিপদমুক্ত থাকলেও রসুনের কেজিতে এ বছর ৩০ থেকে ৬০ টাকা, দেশি আদায় ৮০ থেকে ১১০ টাকা, বিদেশি হলুদে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, জিরায় ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা এবং শুকনা মরিচে ১৫০ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।

মাংসের বাজারের আগুন দামে হাত পুরছে মধ্যবিত্তের। আতঙ্কে মাংসের বাজারে পা রাখছেন না নিম্নবিত্তরা। সাধ্যের ব্রয়লার মুরগির কেজিও এখন ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত বছরের চেয়ে যা ১০৫ টাকা পর্যন্ত বেশি। ডিমের হালিও ৫০ টাকায় ঠেকেছে।

রোজার মাসে সাধারণত যেসব পণ্যের প্রয়োজন হয় এর মধ্যে রয়েছে মোটা চাল, খোলা আটা, বোতলজাত সয়াবিন, চিনি, ছোলা, খেজুর, অ্যাংকর, মসুর, রসুন, দেশি আদা, বিদেশি হলুদ, শুকনা মরিচ, জিরা, ব্রয়লার মুরগি, গরু, রুই মাছ, ডিম, গুড়া দুধ ও লবণ। এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার যাচাই করলে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে এই ১৯টি পণ্যের দাম গড়ে ৩৭.৮৩ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার রোজায় এসব পণ্যের পেছনে ভোক্তাকে প্রায় ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।

যেখানে রমজানের আগেই সরকারি সংস্থা ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, গত রমজানের তুলনায় এবার পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেশি বাড়বে। কিন্তু বাজারচিত্র বলছে রোজা শুরুর আগেই ভোক্তার খরচ প্রায় ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

মাসদাইর বাজারের মুদি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, রমজান ঘিরে সব পণ্যের দাম বেশি। পাইকাররা গত দুই মাস থেকে ধীরে ধীরে সবগুলো পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহের তুলনায় নতুন করে রমজান নির্ভর পণ্য-ছোলা, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছে। যে কারণে বাড়তি দরে এনে বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক বলেন, রমজানে পণ্যমূল্য ভোক্তা সহনীয় করতে মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। কোনো ধরনের কারসাজি করলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। একসঙ্গে এক মাসের বাজার থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি থাকবে না। আর ঘাটতি না থাকলে অসাধুরা কারসাজি করতে পারবে না।




সর্বশেষ  
জনপ্রিয়  

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন