রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজ রবিবার | ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সোনারগাঁয়ে শিক্ষক সংকটে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ৫:৩৩ অপরাহ্ণ

সোনারগাঁয়ে শিক্ষক সংকটে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

ফাহাদুল ইসলাম সোনারগাঁ প্রতিনিধি

শিক্ষক ও কর্মচারী সংকটে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একমাত্র সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মোগরাপাড়া সরকারি হরিদাস গৌর গোবিন্দ শ্যামসুন্দর স্মৃতি বিদ্যায়তনের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকরাও। এ সংকট কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলতে পারছেন না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রায় নব্বই বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি।

জানা যায়, উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নে প্রায় ২ একর ৪১ শতাংশ জায়গা নিয়ে ১৯৩৪ সালে স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠটি জাতীয়করণের জন্য ২০১৮ সালের ১৪ মে সরকারের অনুকূলে আনুষ্ঠানিকভাবে জমি হস্তান্তর করেন। উপজেলার প্রাচীন ও একমাত্র সরকারি বিদ্যালয় হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় প্রতি শ্রেণিতে দুটি করে শাখা বিভক্ত করে দুটি শিফটে পাঠদান চালাতে হয়।

প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ৩৬০ জন, ৭ম শ্রেণিতে ৩৬০ জন, ৮ম শ্রেণিতে ৩৬০ জন, ৯ম শ্রেণিতে ৩৬০ জন এবং ১০ম শ্রেণিতে ৩৬০ জন করে মোট ১৮শ’ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান দেওয়া এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকের পদ রয়েছে ২৭টি। অথচ গণিত, ইংরেজি, বাংলাসহ ১৪টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। কর্মরত আছেন মাত্র ১৩ জন জন শিক্ষক। এমনকি দপ্তরি, অফিস সহকারী, নৈশপ্রহরীর পদও শূন্য। নিয়মিত ১২ জন এবং খণ্ডকালীন ৫ জন শিক্ষক দিয়ে কোনমতে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। নেই প্রধান শিক্ষক, ভারপ্রাপ্ত দিয়েই চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া নৈশপ্রহরীর পদটি শূন্য থাকায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বিদ্যালয়ের স্থাপনা ও মূল্যবান কাগজপত্র। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যালয়টি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। জাতীয়করণ হওয়ার পর থেকেই শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা।

এদিকে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বিদ্যালয়ের আশপাশে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। প্রতিনিয়তই বিদ্যালয়ে আসতে ও যেতে ছাত্রীদের হতে হয় ইভটিজিংয়ের শিকার।

আব্দুল হান্নান নামে এক অভিভাবক তার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বড় আশা নিয়ে সরকারি স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছি। শিক্ষক সংকটের ফলে ছেলের মানসম্মত পড়ালেখা নিয়ে গভীর শঙ্কার মধ্যে আছি। বড় লোকরা তো প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে পারে। আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্তদের তো সেই সামর্থ্য নাই।

আহসানউল্লাহ নামের আরেক অভিভাবক বলেন, করোনার আতঙ্ক কেটে বড় আশা নিয়ে স্কুল খোলা হলেও এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই সুখকর নয়। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পড়ালেখা নিয়ে অভিভাবকরা গভীর উদ্বেগের মধ্যে আছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে শিক্ষকদের শূন্যপদ থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে গিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে কালবেলাকে বলেন, স্কুলটি বাঁচান, শিক্ষক সংকটে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। স্কুলটি এভাবে চলতে পারে না। যে শিক্ষকগুলো কর্মরত রয়েছে, তাদের ও অনেক বয়স হয়ে গেছে। তারাও সঠিকভাবে আধুনিক পাঠদানের সঙ্গে পরিচিত নয়। নামে মাত্র ট্রেনিং করে চলছে অভিনয়রূপী পাঠদান। এইভাবে চলতে থাকলে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

দশম শ্রেণির কয়েক শিক্ষার্থী জানান, আমাদের বিদ্যালয়টি সোনারগাঁয়ের মধ্যে একমাত্র সরকারি বিদ্যালয়। কিন্তু সরকারি হলেও আমরা কোনো রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না। সরকারি বিদ্যালয়ে ভালো ও পর্যাপ্ত পরিমাণের শিক্ষক থাকে। নিয়মিত পাঠদান ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা থাকে। যা আমাদের বিদ্যালয়ে নেই। ১২ মাসের মধ্যে ৪ থেকে ৫ মাস বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। বাকি সময় শিক্ষক সংকটে নিয়মিত ক্লাসও হয় না। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দারি জানাচ্ছি।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মঞ্জুর হোসাইন কালবেলাকে বলেন, আমাদের সময়ে বিদ্যালয়ের সোনালি যুগ ছিল। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য উপজেলার স্কুলের চেয়ে এই স্কুলের পড়ালেখা ও ফলাফল ছিল ভালো। তাই আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে এখানে পড়াশোনা করত অনেকেই। কিন্তু উন্নয়নের অগ্রগতি ও ডিজিটাল যুগে এই প্রাণের বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার এমন পরিবেশ কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষক সংকটে এক সময়ে আলো ছড়ানো প্রদীপটি এখন প্রায় নিভু নিভু। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট অনুরোধ বিদ্যালয়টিকে যেনো আবার তার সোনালী যুগ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের পর থেকেই আমরা শিক্ষক শূন্যতায় ভুগছি। প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের সঠিক পাঠদান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষকের চাহিদা দিয়ে ইতোমধ্যেই আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। দুই শিফটে একজন শিক্ষক দিয়ে এত বড় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা খুবই কষ্টকর। দ্রুত এই সংকট থেকে মুক্তির দাবি জানাই

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কালবেলাকে জানান, শিক্ষক সংকটে এত পুরনো একটি স্কুলের এই অবস্থা খুবই দুঃখজনক। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই করুণ অবস্থা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কিন্তু জাতীয়করণের পর শিক্ষক নিয়োগ আমাদের হাতে থাকে না। আমরা লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ান-উল-ইসলাম জানান, লিখিতভাবে কয়েকবার শিক্ষক সংকটের বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। আশা করি শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে।

নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকা জানান, বিদ্যালয়টি সোনারগাঁয়ের একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করে জাতীয়করণ করেছি। শিক্ষক সংকটের বিষয়টি আমি জেনেছি। অতিদ্রুতই এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানাব এবং দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।




সর্বশেষ  
জনপ্রিয়  

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন