ক্রাইম রিপোর্টার : বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের বিতর্কিত কর্মকান্ডে ক্ষুব্দ সাধারণ মানুষ। বিরোধী দলকে দমন-নিপিড়নে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা নিরব থাকলেও আগ্রাসী ভুমিকা পালন করেছে পুলিশ।
সর্বশেষ কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নাসিক ৬নং কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি ও থানা আওয়ামী লীগের কয়েক শীর্ষ নেতার প্ররোচনায় বিএনপি, জামায়াতসহ সমমনা দল এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে একে-একে ১৩টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে শুরু করে সারাশী অভিযান।
এসব মামলা দায়েরের পর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ শুরু করে সীমনাহীন গ্রেপ্তার বাণিজ্য। হাতিয়ে নেয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা।
জানা যায়, হাসিনা সরকারের আমলে বিএনপি, জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর সরকার পতনের আন্দোলনকে দমন করতে একের পর মিথ্যে মামলায় জর্জরিত করা হয় নেতাকর্মীদেরকে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতাকর্মীদেরকে বছরের পর বছর পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সরকারকে অনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পরে নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতিতে।
ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে শুরু করে গ্রেপ্তার বাণিজ্য, ভেঙ্গে পড়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা। বেড়ে যায় মাদক, কিশোরগ্যাং, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা ও ভুমিদস্যুতাসহ নানান অপরাধ কর্মকান্ড। এসব অপরাধ কর্মকান্ড দমনে পুলিশের তেমন কোন ভুমিকাই ছিলনা। তারা ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুমে তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মিশনে।
বিভিন্ন সেক্টর থেকে মাসোহারা আদায়ে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। এর ফলেই গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটায় বিক্ষুব্দ জনতা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী জানান, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামরুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এস.আই) আনোয়ার, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ইলিয়াস হোসেন ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শংকর দাস সিদ্ধিরগঞ্জে ব্যাপক গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরা সকলেই যৌথভাবে পরষ্পর সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজগুলো করে থাকেন।
এছাড়া উপ-পরিদর্শক (এসআই) শওকত জামিলের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। একাধিক বিএনপি নেতাদের সাথে ছিলো তার সখ্যতা। গণগ্রেপ্তারের সময় একাধিক বিএনপি নেতাকে সহায়তা করাসহ আবার অনেককেই প্রেপ্তারের পর ছেড়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপি নেতা দেলোয়ার ও সানাড়পাড়ের তাজুলকে গ্রেপ্তারের পর ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে তিনি আলোচনায় উঠে আসেন।
এছাড়াও থানার অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা সিদ্ধিরগঞ্জের চিহ্নিত ছিনতাইকারী, ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে সারাদিন চষে বেড়াতো অলিতে-গলিতে। তারা টার্গেট করে শিকারী ধরে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিত বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এই অসাধু পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভুমিকায় ছিল এসআই কামরুল। তিনি ওসি আবু বক্করের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে সকলকে নিয়ন্ত্রন করে থাকেন বলে জানা যায়।
শামীম ওসমানের অনুগত নেতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোই ছিল তাদের টার্গেট। কদমতলী এলাকায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে আমিনুল ইসলাম টুটুল নামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে নাশকতা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে এসআই কামরুলের বিরুদ্ধে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে লেগুনা ব্যবসার দ্বন্ধকে কেন্দ্র করে নাসিক ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর উদ্দিনের ইন্ধনে শিমরাইল এক্সপ্রেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসানুজ্জামান পরশকে নাশকতা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে এসআই কামরুলের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও কোটা আন্দোলন চলাকালীন সাইনবোর্ড এলাকার মিতালী মার্কেটের কমিটি নিয়ে আভ্যন্তরিন কোন্দলের দ্বন্দে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিনের ইন্ধনে ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন ফারুককে নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ।
এছাড়াও কোটা আন্দোলনকে পুঁজি করে ইয়াছিনের ইন্ধনে তানভীর নামে এক ঠিকাদারের বিরুদ্ধে নাশকতা মামলা দেয় পুলিশ। কোটা আন্দোলনের ঘটনাকে পুঁিজ করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আবু বকর আওয়ামীলীগ নেতাদের হুকুমে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের নামে মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালান। গত ১৯ ও ২০ জুলাইয়ে বিভিন্ন সরকারী স্থাপনায় হামলার ঘটনার পর থেকে থানার প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। এসময় শামীম ওসমানের আশির্বাদপুষ্ট দুই-একজন গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকেই তখন থানায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
এসুযোগে অবাধে গণগ্রেপ্তার চালিয়ে মামলা দেয়া হবে না এবং নরমাল ধারা চালান করা হবে এই মন্ত্র ব্যবহার করে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। ওই পুলিশ কর্মকর্তারা ওসির নেতৃত্বে নানা অপরাধের অভয়াশ্রম হিসেবে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাকে ব্যবহার করছে।
এ দিকে বিতর্কিত পুলিশ অফিসার শওকত জামিলকে বিএনপি নেতাদের সহায়তা ও গ্রেপ্তারের পর ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালিন ২৯ জুলাই থানা থেকে বদলি করা হয় বলে একটি সূত্র জানায়। তবে তাকে প্রশাসনিক কারনে বদলি করা হয়েছে পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
এদিকে থানায় অগ্নিকান্ডের পর থানা সংস্কারের পর পুনরায় পুলিশ সদস্যরা তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসে। এসময় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের পুনরায় কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে দেখে ক্ষোভে ফেপে ফুঁসে উঠছে থানা এলাকার বাসিন্দারা। তাদের দাবি শওকত জামিলের মত অভিযুক্ত ওইসব কর্মকর্তাদের থানা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। নচেৎ ফের এলাকার আইনশৃংখলা অবনতি ঘটতে পারে। জনগণের রোষানলে পড়তে পারেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তরা।
আরশাদ গাজী নামে এক ভুক্তভোগী জানান, আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী কাউন্সিলর মতির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ওসি আবু বক্কর আমাদেরকে মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানী করেছে। আমরা অবিলম্ভে এই ওসি ও তার সহযোগীদের অপসারণ চাই।
এবিষয়ে কথা বলতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বকর সিদ্দিকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।