বৃহস্পতিবার, ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজ বৃহস্পতিবার | ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নারায়ণগঞ্জ সদর একটি লোমহর্ষক খুন, রহস্য উদ্ঘাটনে না’গঞ্জ জেলা পুলিশ

সোমবার, ১০ আগস্ট ২০২০ | ১:১৫ অপরাহ্ণ

নারায়ণগঞ্জ সদর একটি লোমহর্ষক খুন, রহস্য উদ্ঘাটনে না’গঞ্জ জেলা পুলিশ

নারায়ণগঞ্জের ডাক.কম  ;  স্বামীর  অভাবের সংসারে সুখের রেখা টানতে সেলাই মেশিনে বাসায় বসে কাজ করেন। হোসিয়ারি গার্মেন্টসে স্বামী কাজ করে যা রোজগার করেন তা দিয়ে সংসার চালানো অনেক কষ্টের। দুই মেয়ে লেখাপড়া করে। কোন ছেলে নেই তাদের। বড় মেয়ে এবার এসএসসি পাশ করেছে। ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রি। ছেলে সন্তান না থাকলেও মেয়েকে কোন কাজে দেননি তারা। মাঝে মাঝে অভাবের সংসারে বড় মেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে মায়ের সাথে কাজ করতে চায়। কিন্তু রেখা আক্তার সুস্থ থাকতে সেটা করতে দিতে রাজি হননা। রাতে যখন নিস্তব্ধ শহর, তখনও রেখা সেলাই মেশিনে সুতার রেখা টেনে চলেন কাপড়ে। তবে আজকের গল্পটা অন্যরকম রোমহর্ষক।
আদরের দুই মেয়ে জেরিন ও জিসা। ছোট্ট সংসারে অভাব থাকলেও সুখ ছিল। খুব বেশি চাওয়া নেই তাদের। করোনার কারণে গার্মেন্টস বন্ধ হলেও রেখা ঠিকই সংসার সামলেছেন দিন-রাত কাজ করে। ছোট্ট ঘরে চারটি প্রাণ নিয়ে কখনও কারো নিকট হাত পাতেননি। করোনার কারণে যে গার্মেন্টস বন্ধ ছিল তা এখন খোলা হয়েছে। স্বামী জাহাঙ্গীর কাজ করে উপার্জন করছে। এখন তাদের অভাব নেই। তবে ঘটনার শুরু ৪ জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যার পর থেকে। ছোট মেয়ে জিসা(১৪) কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গিয়েছে, কার সাথে গিয়েছে কিছুই জানেনা তারা। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি এমন কারো ঘর নেই যেখানে খোঁজা হয়নি তাঁকে। কিন্তু তারা জানেনা কেউ হারিয়ে গেলে নিকটস্থ থানায় সংবাদ দিতে হয়। কেউ একজন বলেছিল থানায় জিডি করতে। খুব বেশি কর্ণপাত করেনি সে কথায়। অবশেষে ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় গিয়ে মেয়ের নিখোঁজ জিডি করেন রেখা আক্তার। তদন্তকারী অফিসার এসআই শামীম আল মামুন। ঘটনার ১৩ দিন পর জিডি হলেও থেমে থাকেননি তিনি। বারবার রেখা আক্তারের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও গোপন অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন। জিসা কোন মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না। শুধুমাত্র রেখা আক্তারের একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করত পরিবারের সকল সদস্যরা। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কোন ফল পাওয়া যাবে কিনা সেটাও ছিল অনিশ্চিত। তবুও এগিয়ে যান তদন্তকারী অফিসার।
তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা এবং বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সন্দেহ করা হয় অটো রিক্সা চালক রকিবকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে আনা হয় থানায়। পাওয়া যায় ঘটনার কিছু সূত্র। সে অনুযায়ী ৬ আগস্ট অপহরণ মামলা রুজু হয় থানায়। অতঃপর আটক করা হয় আব্দুল্লাহকে। এদের কাউকে চিনেনা রেখা আক্তারের পরিবার। তাদের সাথে কোন পূর্ব শত্রুতাও নেই। তবে তারা কেন অপহরণ করবে জিসাকে? প্রশ্ন থেকেই যায়। এগুতে হবে তদন্তকারী দলকে। রকিব ও আব্দুল্লাহকে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে দুই দিনের পুলিশ রিমাণ্ডে আনা হয়। এবার নতুন তথ্য পাওয়া যায় আব্দুল্লাহর নিকট থেকে। ঘটনার সময় নারায়ণগঞ্জ ইস্পাহানী ঘাট থেকে জিসাকে নিয়ে আব্দুল্লাহ একটি ছোট বৈঠা চালিত নৌকা ভাড়া করেছিল। তখন রাত অনুমান নয়টা। রাত বারোটার দিকে ফিরে এসেছিল আব্দুল্লাহ। তবে ফিরে আসেনি জিসা। আর তার পুরো ঘটনা জানতে হলে যেতে হবে সেই মাঝির নিকট। তবে সে মাঝির নাম জানেনা আব্দুল্লাহ। পুলিশ সুপার নারায়ণগঞ্জ জনাব মোহাম্মদ জায়েদুল আলম, পিপিএম (বার) মহোদয়ের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার চৌকস টিম ও সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসার একসাথে কাজ শুরু করেন পুরো রহস্য উদ্ঘাটনে। ইস্পাহানী ঘাটে থাকা বৈঠা দ্বারা চালিত ১২টি নৌকার মাঝিকে একযোগে জিজ্ঞসাবাদের জন্য আটক করা হয়। হাজির করা হয় আব্দুল্লাহর সামনে। এক এক করে মাঝিকে দেখানো হয় তাঁকে। এবার খুঁজে পাওয়া যায় সেই মাঝিকে, নাম খলিলুর রহমান ওরফে খলিল। এরপর আটক করা হয় তাঁকেও। গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
জিসা খুব সহজ সরল এবং চরম বিশ্বাস প্রবণ একটি মেয়ে। সবাইকে খুব সহজেই বিশ্বাস করত। আব্দুল্লাহর কোন নির্দিষ্ট পেশা নেই। অনেকটা ভবঘুরে স্বভাবের। জিসাদের বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকানে কাজ করেছে কিছুদিন। সেখান থেকেই পরিচয় হওয়ার পর জিসা তাঁকে দিয়েছিল তার মায়ের মোবাইল নম্বর। আব্দুল্লাহর নিজের কোন মোবাইল নেই। এরপর সুযোগ পেলে অন্য কোন মোবাইল থেকে তাদের কথা হতো মাঝে মাঝে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ অটো রিক্সা চালক রকিবের মোবাইল ফোন থেকে ফোন দিয়ে কথা বলে জিসার সাথে। ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে রকিবের অটোতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে রাত নয়টায় ইস্পাহানী ঘাটে যায় তারা। রকিব তাদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে আসে। রাতের নদীতে ভ্রমনের আনন্দ নিতে খলিলের নৌকা ৩০০ টাকায় ভাড়া করে আব্দুল্লাহ। নদীর মাঝে ঘুরতে ঘুরতে একসময় আব্দুল্লাহ ঝাঁপিয়ে পড়ে জিসার উপর। নিজেকে রক্ষা করতে প্রাণপণে চেষ্টা করে জিসা। কিন্তু জিসার শক্তির সাথে পেরে ওঠেনা আব্দুল্লাহ। সাহায্য করে মাঝি খলিল। জিসা’র দু পা ধরে রাখে সে। আর আব্দুল্লাহ জোর পূর্বক ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে জিসাকে। তার গগণবিদারী হাহাকার রাতের আঁধারের নদীতে কেউ শোনেনি। মুখ বন্ধ করে ধরে রাখে আব্দুল্লাহ। তারপর রক্তাক্ত দেহে আবার ধর্ষণ করে মাঝি খলিল। জিসা তখন ক্লান্ত ও অবসন্ন। ধর্ষণের আঘাতে চরম ক্ষতিগ্রস্থ তার শরীর। যন্ত্রণায় কাতর জিসা শুধু বলে বাড়িতে গিয়ে সব বলে দিবে। এমন কথায় ভয় পেয়ে যায় আব্দুল্লাহ ও খলিল। এবার নতুন মিশনে নামে তারা দু’জন। জিসার গলা টিপে ধরে আব্দুল্লাহ আর পা চেপে রাখে খলিল। একসময় নিস্তেজ হয়ে যায় জিসার দেহ। প্রাণ চলে যায় দূর আকাশে। পড়ে থাকে দেহ রাতের আঁধারে নদীর বুকে খলিল মাঝির নৌকায়। স্রোতাস্বিনী শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয় জিসা’র মরদেহ।
০৯ আগস্ট বিজ্ঞ আদালতে নির্মম এ খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেপ্তারকৃত আসামি আব্দুল্লাহ (২২), রকিব (১৯) ও খলিলুর রহমান (৩৬)। আদালতের নির্দেশে আসামিরা এখন জেলখানায় বন্দি। মা রেখার জীবনে আর ফিরে আসবেনা জিসা। এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি জিসার লাশ। শেষ দেখাও হবে কিনা জিসার মুখটা তাও অনিশ্চিত। তবে জড়িত আসামিদের সনাক্ত ও বিচারের মুখোমুখি করতে পেরেছে পুলিশ। জিসার পরিবার কখনো ভাবতে পারেনি তাদের জিসা এমন নির্মম ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়েছে। তারা পুলিশের কাছেও আসতে চায়নি। তবে যখন পুলিশের নিকট এসেছে, পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম দিয়ে অকল্পনীয় ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। পুলিশ এতটুকু না করলেও হয়তো রেখা আক্তারের কোন অভিযোগ থাকত না। কারণ তারা এসবের কিছুই জানেনা বা ভাবতেও পারেনি। শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকেই এমন ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হযেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ। ধন্যবাদ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী টিমের সকল সদস্যদের প্রতি।




সর্বশেষ  
জনপ্রিয়  

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন